রাষ্ট্রবিজ্ঞান কাকে বলে? রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি আলোচনা কর। অথবা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দাও। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিসর বা আওতা সম্পর্কে যা জান লেখ।


 রাষ্ট্রবিজ্ঞান


প্রশ্ন ১.১৩ রাষ্ট্রবিজ্ঞান কি? রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু আলোচনা কর।


অথবা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান কাকে বলে? 


রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি আলোচনা কর। অথবা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দাও। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিসর বা আওতা সম্পর্কে যা জান লেখ।


অথবা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলতে কি বুঝ? রাষ্ট্রবিজ্ঞানের


পরিধি কি ব্যাপক? আলোচনা কর।


উত্তর : ভূমিকা : রাষ্ট্রবিজ্ঞান হলো বিজ্ঞানের সেই শাখা যেখানে রাষ্ট্র ও সরকার নিয়ে আলোচনা করা হয়। গতিশীল শাস্ত্র হিসেবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও পরিধি স্থানীভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি গতিশীল শস্ত্র হওয়ায় সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ধ্যানধারণাও পরিবর্তন হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান অতীতের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বর্তমানকে অনুধাবন করার প্রয়াস চালায় এবং ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নির্ধারণে সহায়তা যোগায়।


→ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শাব্দিক অর্থ : ইংরেজিতে 'Political Science' শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হলো রাষ্ট্রবিজ্ঞান। Politics শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ 'Polis' থেকে যার অর্থ City state বা নগররাষ্ট্র, আর science শব্দের অর্থ বিজ্ঞান। সুতরাং নগররাষ্ট্রের যাবতীয় সমস্যা ও তার সমাধান নিয়ে যে শাস্ত্র আলোচনা করে তাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলে।


• রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আধুনিক অর্থ আধুনিক রাষ্ট্র বিশাল, বিস্তৃত


ও জনবহুল রাষ্ট্র। আধুনিককালে রাষ্ট্র বলতে আর গ্রিসের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র


নগররাষ্ট্রেকে বুঝায় না। আধুনিক অর্থে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলতে রাষ্ট্র


বিষয়ক এমন একটি বিষয়কে বুঝায় যা মানুষের আচার-আচরণ ও


কার্যকলাপ নিয়ে আলোচনা করে।


→ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা : মানুষের রাজনৈতিক জীবনের


সাথে সম্পর্কযুক্ত সকল বিষয়, প্রতিষ্ঠান ও কার্যাবলি নিয়ে যে


শাস্ত্র বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা করে তাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলে। প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন লেখক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কতিপয় উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা দেয়া হলো :


ম্যাক্সওয়েবার (Max Weber) বলেন, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান একাধারে বাস্তববাদী ও আদর্শবাদী বিজ্ঞান, যা ন্যায়নীতি অনুসন্ধানের দিক থেকে মানবাচরণ সম্পর্কে আলোচনা করে।”


অধ্যাপক গার্নার (Garner) বলেন, "Political Science


begins and ends with the state অর্থাৎ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শুরু ও


সমাপ্তি রাষ্ট্রকে নিয়ে।


পল জানেট (Paul Janet)-এর মতে, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান হলো। সামাজিক বিজ্ঞানের সেই শাখা, যা রাষ্ট্রের ভিত্তি ও সরকারের নীতিমালা নিয়ে আলোচনা করে।” (Political Science is that part of Social Science which deals the foundations of the




লাসওয়েল (Lassell)-এর ভাষায়, সমাজের অন্তর্ভুক্ত প্রভাব ও


প্রভাবশালীদের ক্রিয়াকলাপের বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনাই হলো রাষ্ট্রবিজ্ঞান।” অধ্যাপক গিলক্রিস্ট (Gilchrist)-এর মতে, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান


রাষ্ট্র ও সরকার নিয়ে আলোচনা করে”। → রাষ্ট্রের পরিধি বা বিষয়বস্তু : রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধিভুক্ত


বিষয়সমূহ আলোচনা করা হলো : ১. রাজনৈতিক জীবন : সমাজবদ্ধ মানুষের রাজনৈতিক


জীবনের আলোচনাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় বিষয়। রাষ্ট্রকে কেন্দ্র


করেই মানুষের রাজনৈতিক জীবন আবর্তিত হয়।


২. যুদ্ধ ও চলতি বিশ্ব যুদ্ধ ও সাম্প্রতিক সংঘটিত সকল বিষয়ই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার বিষয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান যুদ্ধ, বিশেষ করে স্নায়ুযুদ্ধ এবং অবসান, বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একনায়কত্ব, বর্তমান অর্থনৈতিক মেরুকরণ ইত্যাদি নিয়েও আলোচনা করে।


৩. তুলনামূলক রাজনীতি : আধুনিককালে তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দুই বা ততোধিক দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার অধ্যয়ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতিতে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রসমূহ নিজেদের রাজনৈতিক উন্নয়নের জন্য তুলনামূলক রাজনীতি চর্চার দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের তুলনামূলক রাজনীতি তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্যতম পরিধিভুক্ত বিষয়।


৪. নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য : নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিশেষভাবে আলোচনা করে থাকে। এরূপ আলোচনার ফলে সুনাগরিকতার চেতনাবোধ জাগ্রত হয়। তাই নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্য বিষয়ক আলোচনাও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি বা বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত।


৫. জনমত জনমতের গুরুত্ব রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। রাষ্ট্রের জনগণের কল্যাণকামী মতই হলো জনমত। জনমত আধুনিক শাসনব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনমতের বাহন ও ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল কাজ। সুতরাং জনমত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল আলোচ্য বিষয়।


৬. রাষ্ট্র সম্পর্কিত জ্ঞান রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও কার্যাবলি


সম্পর্কিত মতবাদসমূহ, রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে


রাষ্ট্রবিজ্ঞান গুরুত্ব সহকারে পর্যালোচনা করে।


৭. পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনীতি রাষ্ট্রবিজ্ঞান আন্তর্জাতিক রাজনীতির আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কূটনীতির উৎপত্তি, কার্যাবলি, শ্রেণিবিন্যাস ইত্যাদি আলোচনা করে। কেননা, কূটনীতি রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক সৃষ্টি করে। অন্যদিকে নিজ রাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষা করার জন্য একটি রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের যে সম্পর্ক তা পররাষ্ট্রনীতি। পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য ও উদেশ্যাবলি সম্পর্কেও রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্যক আলোচনা করে।



৮. বিশ্ব রাজনীতির অন্যান্য বিষয়াবলি : জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতির রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা, সরকারের তুলনামূলক আলোচনা, নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্য, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার তৎপরতা প্রভৃতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার ক্ষেত্রকে সমৃদ্ধ করে।


৯. রাজনৈতিক অঙ্গ সংগঠন : রাষ্ট্রবিজ্ঞান সরকারি কাঠামো, রাজনৈতিক দল, চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী ইত্যাদি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করে। সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন, জনমত ও প্রচারণার প্রভৃতি বিষয়াবলি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এখতিয়ারভুক্ত।


১০. উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ : শক্তিশালী রাষ্ট্র কর্তৃক দুর্বল রাষ্ট্রের উপর আধিপত্য বিস্তার করাকে সাম্রাজ্যবাদ বলে। সাম্রাজ্যবাদের নতুন রূপ হলো উপনিবেশবাদ। সাম্রাজ্যবাদের প্রকৃতি, গঠন এবং নতুন সাম্রাজ্যবাদের আলোচনা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধিভুক্ত।


১১. আইন ও শাসনব্যবস্থার আইন প্রণয়ন রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। রাষ্ট্রের পক্ষে সরকার আইন প্রণয়ন করে। আইনের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয়। আইন ও শাসনব্যবস্থার আলোচনা তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্যতম পরিধিভুক্ত বিষয়।


১২. সরকারের আলোচনার ক্ষেত্র রাষ্ট্র পরিস্ফুট হয়ে উঠে সরকারের মাধ্যমে। সরকার ছাড়া রাষ্ট্র কল্পনা করা যায় না। অ সরকারের মাধ্যমেই রাষ্ট্র তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে বাস্তবে রূপায়িত করে। তাই রাষ্ট্রের আলোচনার সময় সরকারের আলোচনাও স্বাভাবিকভাবে এসে পড়ে।


১৩. নৈতিকতা রাষ্ট্রবিজ্ঞান মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন বিষয়ের উচিত অনুচিত, ভালোমন্দ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করে। অর্থাৎ রাষ্ট্রবিজ্ঞান শুধু বর্তমানে যা আছে তা নিয়েই আলোচনা করে না, বরং কি হওয়া উচিত, কি অনুচিত তাও স্থির করে দেয়। রবসন (Robson) বলেছেন, মানুষের নৈতিক সমস্যা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় হিসেবে গণ্য হয়। কেবল নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই নয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান মানুষের নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েও আলোচনা করে।


১৪. রাজনৈতিক অর্থনীতি : কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণার


সূত্রপাত থেকেই রাষ্ট্রবিজ্ঞান অর্থনীতিকে তার একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হিসেবে সংযোজিত করেছে। মূলত বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারণা প্রসার লাভ করায় রাজনীতির সাথে অর্থনীতির ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে রাজনৈতিক অর্থনীতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।


উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি। ব্যাপক এবং তা ক্রমস সম্প্রসারণশীল। সমাজবদ্ধ মানুষের রাজনৈতিক আচরণ ও কার্যাবলির আলোচনাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় বিষয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান হলো একটি গতিশীল সমাজবিজ্ঞান । সমাজবিজ্ঞানের স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে এর আত্মপ্রকাশ খুব বেশি। দিনের না হলেও বর্তমানে এটি একটি সমৃদ্ধ শাস্ত্র।

Post a Comment

0 Comments